দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন
অরক্ষিত লেভেলক্রসিংয়ে থেমে নেই মৃত্যু

কারণ, এই পথে থাকা ৭২টি লেভেল ক্রসিংয়ের মধ্যে মাত্র ১৬টিতে গেট বা গেটম্যান রয়েছে। বাকি ৫৬টি পুরোপুরি অরক্ষিত। এরই মধ্যে ২০ মাসে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৩০ জন। এর মধ্যে সদ্য গত ২ আগস্ট রামুর রশিদনগরে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ট্রেনের ধাক্কায় দুমড়ে-মুচড়ে যায়, প্রাণ হারায় চালকসহ একই পরিবারের ৩ সদস্য।
রেলওয়ে পুলিশ ও কক্সবাজার জেলা পুলিশের দেয়া তথ্য মতে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ২০ মাসে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথে অন্তত ৩০টি প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। শুধু গত ১ বছরে মৃত্যু হয়েছে ১৭ জনের। এ ছাড়া রেললাইনে ট্রেনের ধাক্কায় হাতির মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে।
গত ১ আগস্ট রামু উপজেলার রশিদনগর এলাকার একটি অনুমোদিত লেভেল ক্রসিংয়ে ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। ঢাকার উদ্দেশ্যে কক্সবাজার থেকে ছুটে চলা ট্রেনটি পার হওয়ার সময় একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশাকে প্রায় এক কিলোমিটার টেনে নিয়ে যায়। মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারান চালক ও একই পরিবারের তিন সদস্য।
এই লেভেল ক্রসিংয়ে কোনো গেটম্যান বা সিগন্যাল ছিল না বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় বাসিন্দা নবাব মিয়া। তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন আতঙ্ক নিয়ে এই ক্রসিং পার হই। ট্রেনের আনুমানিক সময় আন্দাজ করে পার হতে হয়।’
দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথে ৭২টি লেভেল ক্রসিং, ৫৬টি অরক্ষিত
রেলওয়ে বিভাগের দেয়া তথ্যমতে, দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথে মোট ৭২টি লেভেল ক্রসিং রয়েছে। এর মধ্যে গেট ও গেটম্যান রয়েছে মাত্র ১৬টিতে। ৫৬টি সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় আছে। সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ইসলামাবাদ-রামু সেকশনে ১৭টি ক্রসিংয়ের মধ্যে গেটম্যান রয়েছে মাত্র একটি।
চকরিয়া-ডুলাহাজারা, ডুলাহাজারা-ইসলামাবাদ, হারবাং-চকরিয়া, সাতকানিয়া-লোহাগাড়া সেকশনেও একই চিত্র। কিছু জায়গায় সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে, ‘এই গেটে কোনো গেটম্যান নেই। নিজ দায়িত্বে পারাপার করুন।’ অথচ বাস্তবতা হলো, এসব সাইনবোর্ড ট্রেন আসার সময় জীবন বাঁচাতে পারে না।
নবাব মিয়া জানান, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার আরেকটি বড় কারণ দৃশ্যমানতার অভাব। অনেক জায়গায় গাছগাছালির ঘনত্ব এবং সড়কের বাঁকের কারণে ট্রেন আসা দেখাই যায় না। চালক ও পথচারীরা অনেক সময় হুইসেল শোনার আগেই পার হওয়ার চেষ্টা করেন। এতে প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা ঘটছে নিয়মিত।
রেল কর্তৃপক্ষ বলছে, দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ চালু হলেও এখানকার স্থায়ী জনবল নিয়োগ এখনো অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পায়নি। ফলে প্রকল্পের আওতায় অস্থায়ীভাবে কিছু গেটম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
প্রকল্প পরিচালক মো. সবুক্তগীন জানান, সব লেভেল ক্রসিং অনুমোদিত। কিছু জায়গায় গেটম্যান দেওয়া হয়েছে। বাকিগুলোতে প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
তিনি আরও জানান, দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমাতে ইতোমধ্যে ৪৬টি আন্ডারপাস নির্মাণ করা হয়েছে। জনসচেতনতাই হতে পারে দুর্ঘটনা কমানোর প্রধান অস্ত্র।
চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার আধুনগর উচ্চবিদ্যালয়ের কাছে তিনপথের একটি গুরুত্বপূর্ণ রেলক্রসিং রয়েছে। সেখানে প্রতিদিন প্রায় পাঁচ হাজার পথচারী চলাচল করে। অথচ সেখানে নেই কোনো গেট, নেই কোনো গেটম্যান।
স্থানীয় চেয়ারম্যান নাজিম উদ্দিন বলেন, অবস্থা এমন, যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মাহমুদ ওমর ইমাম বলেন, যেসব রেলক্রসিং ব্যস্ত এবং দৃশ্যমানতা কম, সেখানে অবশ্যই স্বয়ংক্রিয় ব্যারিয়ার, সিগন্যাল লাইট এবং সার্বক্ষণিক গেটম্যান থাকা উচিত।
এ রকম অবস্থা থাকলে দুর্ঘটনা আটকানো কঠিন এবং অনেক সময় ব্রেক কষলেও দুর্ঘটনা এড়ানো যায় না বলে জানিয়েছেন, কক্সবাজার আইকনিক রেল স্টেশনের মাস্টার মোহাম্মদ গোলাম রব্বানী।
তিনি বলেন, নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থার পাশাপাশি রেলপথ ঘনিষ্ট মানুষের মাঝে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা সম্ভব হলে দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমানো সম্ভব।
এদিকে ৩ আগস্ট দুপুরে দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন এবং ২ আগস্ট নিহতদের পরিবারের স্বজনদের খোঁজ খবর নিয়েছেন কক্সবাজার সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা নিলুফার ইয়াছমিন।
এ সময় তিনি বলেছিলেন, এই রেলপথের প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান নির্মাণ সম্পন্ন করে রেল কর্তৃপক্ষের কাছে এখনো হস্তান্তর করেনি। এতে রেল কর্তৃপক্ষেরও কার্যকর ও স্থায়ী নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে আপদকালীন সময়ে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এবং রেল কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে নিরাপত্তা জোরদারে প্রচেষ্টা চলছে।
পাঠকের মতামত